তিন দফা দাবিতে আন্দোলনে নেমে পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হওয়ার পর নতুন কর্মসূচি দিয়েছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা।
বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকেরা জাতীয় বেতন–স্কেলের ১৩তম গ্রেডে বেতন পান। তা ১০ম গ্রেডে করার দাবিতে এখন আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষকেরা। তাঁদের অন্য দুটি দাবি হলো শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি এবং চাকরির ১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড দেওয়া।
কিছুদিন আগে তাঁরা সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ১১তম করার দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন। তবে সেখান থেকে এগিয়ে এখন ১০তম গ্রেডে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন।
নতুন কর্মসূচি অনুযায়ী তাঁরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন, পাশাপাশি বিদ্যালয়গুলোতে পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালন করবেন।
আন্দোলনকারী ‘প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদ’–এর নেতা মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ এ তথ্য জানান।
এর আগে ৮ নভেম্বর বিকেলে শাহবাগে প্রাথমিক শিক্ষকদের মিছিলে পুলিশ চড়াও হয়। লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস, জলকামান, সাউন্ড গ্রেনেডে শতাধিক শিক্ষক আহত হন। শিক্ষকদের অভিযোগ, পুলিশ হামলা চালিয়েছে বিনা উসকানিতে। অন্যদিকে পুলিশ বলছে, শিক্ষকেরা বাধা উপেক্ষা করে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার দিকে এগোলে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়।
হামলার পরপরই শামছুদ্দীন মাসুদ বলেছিলেন, তাঁরা শহীদ মিনারে ফিরে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতির পদে রয়েছেন। এমন আরও কয়েকটি সংগঠন নিয়ে ‘প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদ’ গড়ে তুলে এই আন্দোলন চলছে।
এত দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বেতন গ্রেড ছিল ১১তম। দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে রিট আবেদনকারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪৫ জন প্রধান শিক্ষকের বেতন গ্রেড এক ধাপ বাড়িয়ে দশম গ্রেডে উন্নীত করা হয়েছে। এর ফলে সারা দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব প্রধান শিক্ষকের বেতন দশম গ্রেড হওয়ার পথ তৈরি হলো।
সেই প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে শিগগিরই সরকারি সিদ্ধান্ত আসতে পারে। সরকারি সূত্রগুলো বলছে, সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ১১তম করার চেষ্টাও করছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা যা বলছেন
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেছেন, ‘সহকারী শিক্ষকদের বর্তমান অবস্থান ১৩তম গ্রেড। প্রধান শিক্ষকদের আমরা সবেমাত্র দশম গ্রেডে উন্নীত করেছি, তাহলে সহকারী শিক্ষকদের হঠাৎ করে ১৩তম গ্রেড থেকে কীভাবে দশম গ্রেডে উন্নীত করব?’
৮ নভেম্বর খুলনা জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে ‘প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অংশীজনের ভূমিকা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে উপদেষ্টা এসব কথা বলেন।
অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, ‘আমরা তিন দফা দাবি দেখেছি। প্রথমটা দশম গ্রেড, পরেরটা ১০ ও ১৬ বছরে সিলেকশন গ্রেড, তিন নম্বরটা শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি। আমরা পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রস্তাব করেছিলাম শতভাগ। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলেছে, সরকারের নীতি হচ্ছে এসব ক্ষেত্রে শতভাগ না দিয়ে সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ দেওয়া, ২০ শতাংশ আমাদের রাখতে হবে নতুন নিয়োগের জন্য। ফলে ওনাদের পরামর্শ মোতাবেক সেটা করা হয়েছে। ১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে যে টাইম স্কেল, সেটা বেতন কমিশন দেখবে, এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। দশম গ্রেড প্রসঙ্গে যেটা আসছে, প্রাথমিক শিক্ষকদের একটা অংশ এই দাবিটা করে, বেশির ভাগ শিক্ষক মনে করেন, এই দাবিটা মোটেই যৌক্তিক না।’
দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের প্রধান শিক্ষকেরা ১২ ও ১১ গ্রেডে বেতন পেতেন। বর্তমান সরকার তাঁদের দশম গ্রেডে উন্নীত করেছে। প্রাথমিক শিক্ষকদের সংখ্যা অনেক বেশি। বড় আর্থিক সংশ্লেষ আছে এখানে। সরকার মনে করেছে প্রধান শিক্ষকদের দাবিটা যুক্তিসংগত ছিল। এ জন্য প্রধান শিক্ষকের দাবিটা আমরা বাস্তবায়ন করেছি।’
অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, ‘সহকারী শিক্ষকেরা ১৩তম গ্রেড থেকে এক লাফ দিয়ে দশম গ্রেডে যাবেন, যেখানে মাত্র প্রধান শিক্ষকেরা দশম গ্রেড পেয়েছেন, এটা যুক্তিসংগত কি না, আপনারাই বিবেচনা করে দেখেন। আমি যতটুকু জানি, সহকারী শিক্ষকদের এই দাবিটা যুক্তিসংগত না।’ তিনি বলেন, ‘সহকারী শিক্ষকেরা যাতে ১১তম গ্রেড পেতে পারেন, সে জন্য আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ে লিখেছি, বেতন কমিশনে লিখেছি। বেতন কমিশন ছাড়াও অন্যান্য নীতিনির্ধারক যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে আমি লবিং করছি যে ১১তম গ্রেড যেন বাস্তবায়ন করা হয়। আমি কতটুকু পারব নিশ্চিত না। তবে আমি লেগে আছি। ফলে দশম গ্রেডের দাবি তুলে এই মুহূর্তে আন্দোলনে যাওয়া আমার কাছে খুব যৌক্তিক মনে হয় না।’
শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে পড়াশোনার ক্ষতি হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘ওনারা যেহেতু স্বাধীন দেশের নাগরিক, ওনাদের কথা বলার সুযোগ আছে। ওনারা আন্দোলন করতে পারেন। কিন্তু আমরা যেটা দেখব, আমাদের পড়াশোনা যাতে বিঘ্নিত না হয়। এই ব্যাপারে আমরা সর্বোচ্চ কঠোর ব্যবস্থা নেব, যদি আমাদের পড়াশোনা বিঘ্নিত হয়। আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনার মানের উন্নয়নের বিষয়টাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। এই পর্যায়ে এসে যদি অযৌক্তিক দাবি দিয়ে কেউ পড়াশোনাকে বিঘ্নিত করে, সে জন্য আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব।’

