ইতিহাস গড়ে নিউইয়র্ক নগরের প্রথম মেয়র মুসলিম হিসেবে নির্বাচিত হয়ে জোহরান মামদানি ধন্যবাদ জানালেন তাঁর স্ত্রী ও মা–বাবাকে।
নির্বাচনে জয়ী ঘোষণার পর আবেগঘন এক ভাষণে জোহরান তাঁর মা-বাবা ও স্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন।
জোহরান মা-বাবাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আজ আমি যে মানুষ হয়েছি, তা তোমাদের জন্যই। তোমাদের সন্তান হতে পেরে আমি গর্বিত।’
জোহরান মামদানি একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম। তাঁর মা ভারতের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ার। বাবা কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের খ্যাতিমান অধ্যাপক মাহমুদ মামদানিও জন্মগতভাবে ভারতীয়।
স্ত্রী রামাকে উদ্দেশ করে জোহরান বলেন, ‘এই মুহূর্তে ও জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তোমাকে পাশে পেতে চাই। এটাই আমার সবচেয়ে প্রিয় মুহূর্ত।’
নিউইয়র্কের ১১১তম মেয়র হলেন মামদানি। ৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী মামদানি সহজ ব্যবধানে পরাজিত করেন সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমো ও রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়াকে। কুয়োমো ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারিতে পরাজয়ের পর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়েন। আর বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস গত সেপ্টেম্বরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়িয়ে কুয়োমোকে সমর্থন জানান।
প্রায় এক বছর আগে রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করা মামদানির জন্য এটি এক অবিস্মরণীয় উত্থান। একজন তুলনামূলক অখ্যাত স্টেট অ্যাসেম্বলিম্যান থেকে আমেরিকার সবচেয়ে বড় শহরের নেতৃত্বে পৌঁছে গেলেন তিনি। মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে তিনি নিউইয়র্কের প্রভাবশালী এক রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরসূরিকে দু’দুবার হারিয়ে দেন।
এখন জাতীয়ভাবে পরিচিত এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে মামদানিকে সামলাতে হবে বিশাল প্রশাসনিক কাঠামো, বাস্তবায়ন করতে হবে তার উচ্চাভিলাষী নীতিমালা, এবং প্রগতিশীল রাজনীতির জাতীয় ধারায় প্রভাব বিস্তার করতে হবে। তার ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ভাড়া নিয়ন্ত্রিত ফ্ল্যাটে ভাড়া বৃদ্ধিতে স্থগিতাদেশ, সার্বজনীন শিশুসেবা, বিনামূল্যে বাস চলাচল ব্যবস্থা ও সিটি করপোরেশন পরিচালিত মুদি দোকান চালু করা।
কুইন্সে হাজারো সমর্থকের সামনে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে এক সমাবেশে মামদানি বলেন, ‘এমন মুহূর্ত যেন আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল—এমনটা ভাবতে ইচ্ছে করে। কিন্তু যখন আমি প্রচারণা শুরু করি, তখন সেখানে একটিও টেলিভিশন ক্যামেরা ছিল না।’ তিনি যোগ করেন, ‘চার মাস পর, ফেব্রুয়ারিতেও আমাদের সমর্থনের হার ছিল মাত্র ১ শতাংশ—আমরা ছিলাম সেই প্রার্থীর সঙ্গে সমান, যার নাম ছিল “অন্য কেউ”।’
মামদানির এই জয়ের প্রভাব শুধু নিউইয়র্কেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; তা সারা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে আলোচনার জন্ম দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নিউইয়র্কে এখন তার প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে অ্যালবানি ও সিটি কাউন্সিলের নেতাদের ঐক্যবদ্ধ করা—যাদের অনেকেই শুরুতে তার পাশে দাঁড়াতে অনীহা প্রকাশ করেছিলেন।
জাতীয় পর্যায়ে ডেমোক্র্যাট নেতারা খতিয়ে দেখবেন, কীভাবে মামদানি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের বার্তা ছড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছেছেন এবং জীবনযাত্রার ব্যয় সংকটকে প্রধান ইস্যু বানিয়েছেন—যা তাদের নিজেদের নির্বাচনী লড়াইয়েও দিকনির্দেশনা দিতে পারে। অন্যদিকে রিপাবলিকানরা ইতিমধ্যেই মামদানির বামঘেঁষা নীতিকে কেন্দ্র করে নতুন রাজনৈতিক বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
এনবিসি নিউজের এক্সিট পোল অনুযায়ী, মামদানি নিউইয়র্কের প্রায় সব জাতিগত গোষ্ঠীর ভোট পেয়েছেন—শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, লাতিনো, এশীয় ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর ভোটারদের বড় অংশই তাকে বেছে নিয়েছেন। ৪৫ বছরের নিচের ভোটারদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ছিল বিপুল; কুয়োমোর চেয়ে ৪৩ পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন তিনি। অন্যদিকে ৪৫ বছরের ঊর্ধ্বে ভোটারদের মধ্যে কুয়োমো ১০ পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন।
শিক্ষাগত পার্থক্যও ভোটের ফলাফলে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে এক্সিট পোল জানায়। এছাড়া গত ১০ বছরে নিউইয়র্কে বসতি স্থাপন করা নতুন বাসিন্দা ও জন্মসূত্রে নিউইয়র্কে থাকা ভোটারদের মধ্যেও স্পষ্ট বিভাজন দেখা গেছে।
তবে মামদানির ফিলিস্তিনপন্থী অবস্থান নির্বাচনজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। তার মুসলিম পরিচয় ও ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান নিয়ে বিরূপ প্রচারণা চললেও শেষ পর্যন্ত ভোটাররা তাকেই সমর্থন দেন। এক্সিট পোল অনুযায়ী, ইহুদি ভোটারদের মধ্যে কুয়োমো এগিয়ে ছিলেন ৬০% ভোটে, যেখানে মামদানি পান ৩১% ভোট।
নির্বাচনের শেষ সপ্তাহগুলোতে মামদানি ও কুয়োমোর মধ্যে তীব্র বাকযুদ্ধ হয়। কুয়োমো তাকে ‘নিউইয়র্কে বিভাজন সৃষ্টিকারী’ বলে আখ্যা দেন, অন্যদিকে মামদানি কুয়োমোকে ট্রাম্পের ‘কাঠপুতলি’ বলে সমালোচনা করেন। নির্বাচনের আগের রাতেই ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কুয়োমোকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, স্লিওয়াকে ভোট দেওয়া মানে মামদানিকে ভোট দেওয়া।
একইসঙ্গে এক্সিট পোল থেকে জানা যায়, রিপাবলিকান ভোটারদের বড় অংশ স্লিওয়ার চেয়ে কুয়োমোকেই সমর্থন করেছেন—রিপাবলিকানদের ৬১% ভোট গেছে কুয়োমোর পক্ষে, আর স্লিওয়া পেয়েছেন ৩৫%।
গত মাসের শেষদিকে এক আবেগপূর্ণ ভাষণে মামদানি বলেন, তিনি নিজের মুসলিম পরিচয় নিয়ে ‘বর্ণবাদী ও ভিত্তিহীন’ আক্রমণের মুখে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘তারা এই নির্বাচনকে বানাতে চেয়েছে আমার ধর্মবিশ্বাসের ওপর গণভোট, কিন্তু আমি লড়েছি নিউইয়র্কবাসীর জীবনযাত্রার ব্যয় সংকটের বিরুদ্ধে।’
নিউইয়র্কের ইতিহাসে তিনিই হতে যাচ্ছেন প্রথম মুসলিম মেয়র। তার বিজয় শুধু নিউইয়র্ক নয়, সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে প্রগতিশীল রাজনীতির জন্য এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে দিল।
কে মামদানি?
নিউইয়র্ক সিটি—বিশ্ববাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র, আধুনিক সভ্যতার প্রতীক। এই শহরের নেতৃত্ব এখন যাচ্ছে এক তরুণ মুসলিম ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাজনীতিকের হাতে। তার নাম জোহরান মামদানি। তাকে ঘিরে এখন শুধু মার্কিন রাজনীতিই নয়, আলোচনায় সরব গোটা বিশ্ব।
৩৪ বছর বয়সী জোহরান মামদানি যদি মেয়র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নেন, তাহলে তিনি হবেন নিউইয়র্ক সিটির ইতিহাসে প্রথম মুসলিম, প্রথম দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত এবং সর্বকনিষ্ঠ মেয়র।
শৈশব ও পরিবার
জোহরান মামদানি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৯১ সালের ১৮ অক্টোবর, উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায়। তার মা প্রখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ার, আর বাবা মাহমুদ মামদানি একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী, যিনি ভারতের মাটিতে জন্ম নিলেও উগান্ডার নাগরিক।
মাত্র পাঁচ বছর বয়সে পরিবারসহ দক্ষিণ আফ্রিকায় যান জোহরান, এরপর সাত বছর বয়সে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন নিউইয়র্কে। ছোটবেলা থেকেই তিনি বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও অভিবাসী জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, যা পরে তার রাজনৈতিক চিন্তাধারায় গভীর প্রভাব ফেলে।
রাজনীতিতে উত্থান
২০২০ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টির হয়ে তিনি নির্বাচিত হন নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলির সদস্য হিসেবে। এখান থেকেই শুরু হয় তার রাজনৈতিক উত্থান। সাধারণ মানুষের সমস্যা, বিশেষত ভাড়া, গণপরিবহন ও শিক্ষা নিয়ে সরাসরি কাজ করে তিনি দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
২০২৪ সালে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেন—তখনো তিনি তুলনামূলক অপরিচিত মুখ। কিন্তু মাত্র এক বছরের মধ্যেই তিনি নিউইয়র্কের রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত প্রার্থী হয়ে ওঠেন।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও জনপ্রিয়তা
এই নির্বাচনে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমো এবং রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া। প্রথমে বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিলেও জনসমর্থনের অভাবে সরে দাঁড়ান। যদিও মামদানি তরুণ ও তুলনামূলক অনভিজ্ঞ, তার প্রচারাভিযান ছিল জনমানুষের ইস্যুতে সরাসরি সংযুক্ত। তিনি বারবার বলেছেন, বিশ্ব বদলাতে বয়স বা অভিজ্ঞতা নয়, প্রয়োজন হয় ইচ্ছা আর সততা।
তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে ছিল— • স্থায়ী ভাড়ার সীমা নির্ধারণ • গণপরিবহন বিনামূল্যে করা • শিশু যত্নের সার্বজনীন সুযোগ • ধনীদের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করে সামাজিক কল্যাণে ব্যয় এই প্রতিশ্রুতিগুলো শহরের শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে দ্রুত সাড়া ফেলে দেয়।
আন্তর্জাতিক ইস্যুতে অবস্থান
জোহরান মামদানি শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সরব। তিনি গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন ও গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার। তার দাবি, গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত নেতানিয়াহু নিউইয়র্কে এলে তাকে গ্রেপ্তার করা উচিত।
এমন অবস্থানের কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে তার সমালোচনা করেন এবং হুমকি দেন, মামদানি জিতলে নিউইয়র্কের ফেডারেল তহবিল বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু এই বক্তব্য উল্টো মামদানির জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দেয়।

