রাশিয়ায় মসজিদের ইতিহাস অনেক পুরনো। জামে মসজিদ নামে দেশটির প্রাচীনতম মসজিদটি নির্মিত হয়েছে ৮ম শতাব্দীতে। পর্যটকদের ভ্রমণ তালিকায় শীর্ষে রয়েছে সব থেকে প্রাচীন এই মসজিদ। অনেকেই পরিদর্শন করেন মসজিদটি। এই মসজিদ ছাড়াও রাশিয়ায় ঐতিহাসিক ও প্রাচীন অনেক মসজিদ আছে।
এখানে রাশিয়ার এমন ৭টি প্রাচীন মসজিদের পরিচিতি তুলে ধরা হলো যেগুলো বিভিন্ন শাসকের সময় ভাঙা হয়েছে, কখনো দখলের কবলে পড়েছে, তবে ভাঙন, দখলেও পরও ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে এখনো টিকে আছে মসজিদগুলো।
১. জামে মসজিদ, দারবেন্ত – ৮ম শতাব্দী
রাশিয়ার দাগেস্তানের দারবেন্তে অবস্থিত জামে মসজিদ রাশিয়ার ভূখণ্ডে নির্মিত প্রথম মসজিদ। মসজিদটি নির্মিত হয়েছে ৭৩৩-৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে। তৎকালীন সময়ে মসজিদটি শহরের সর্ববৃহৎ মসজিদ হিসেবে পরিচিত ছিল।
মসজিদটির নতুন অবয়ব নির্মিত হয়েছে ১৩৬৮ সালে। বর্তমানে এর আয়তন ২,১০০ বর্গমিটার। মসজিদের পাশে একটি মাদরাসা আছে, যা ১৫শ শতাব্দীতে তৈরি করা হয়েছে। বর্তমানে মসজিদ ও মাদরাসার ভবন দুটিই সংরক্ষিত আছে।
সোভিয়েত আমলে ১৯৩৮-১৯৪৩ সালে মসজিদটি কারাগারে রূপান্তরিত হয়েছিল। পরে ১৯৪৩ সালে মসজিদটি মুসলিমদের কাছে ফেরত দেওয়া হয়। বর্তমানে এটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের মর্যাদা পেয়েছে।
২. উজবেক খান মসজিদ, ক্রিমিয়া – ১৪শ শতাব্দী
ক্রিমিয়া ইউক্রেনের ঐতিহাসিক ছোট একটি শহর হলেও ২০১৪ সাল থেকে এটি রাশিয়ার দখলে রয়েছে। শহরটি ১৩শ থেকে ১৪শ শতাব্দীতে গোল্ডেন হোর্ডের (মঙ্গোল সাম্রাজ্যের উত্তরপশ্চিমাঞ্চল) একটি প্রশাসনিক রাজধানী ছিল। তৎকালীন সময়ে এটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক শহর ছিল। এখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করতো।
গোল্ডেন হোর্ডের উজবেক খান ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তার শাসনামলে ইসলামকে হোর্ডের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন। তার নির্দেশে ১৩১৪ সালে সেখানে প্রথম মসজিদ নির্মিত হয়।
বর্তমানে সংরক্ষিত যে মসজিদটি দেখা যায় তা ১৫শ শতাব্দীর শুরুতে নির্মিত, একে রাশিয়ার দ্বিতীয় প্রাচীনতম সংরক্ষিত মসজিদ হিসেবে গণ্য করা হয়। মসজিদের পেছনে ১৩২০-এর দশকে নির্মিত একটি মাদরাসার ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান রয়েছে।
৩. খানের মসজিদ, কাসিমভ – ১৬শ শতাব্দী
রিয়াজান অঞ্চলের কাসিমভ ছিল কাসিম খানাতের (যাযাবর মঙ্গোল এবং তুর্কি বা তাতার সমাজ) রাজধানী। যা রাশিয়ার ভূখণ্ডে এক সময়ের শক্তিশালী গোল্ডেন হোর্ডের শেষ অংশ ছিল। এই খানাত ১৬৮১ সালে শেষ শাসকের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বিলুপ্ত হয়।
কাসিমভ শহরে অবস্থিত মসজিদটি ঠিক কবে নির্মাণ করা হয়েছিল তা নিশ্চিতভাবে জানা যায় না; ১৫শ বা ১৬শ শতাব্দীর মধ্যে যেকোনো সময় নির্মিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তবে এর মিনারটি ১৬শ শতাব্দীর নিমার্ণ শৈলীর প্রমাণ বহন করে।
১৭০২ সালের দিকে তাতারদের খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করার নীতি চালু হয়। এ সময় মসজিদটি প্রায় ধ্বংস করা হয়।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, জার পিটার (১৭২১ থেকে ১৭২৫ সাল পর্যন্ত সমস্ত রাশিয়ার প্রথম সম্রাট) ভোলগা নদীতে ভ্রমণের সময় দূর থেকে মসজিদটিকে গির্জা মনে করে ক্রুশ আঁকার মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানান। পরে ভুল বুঝতে পেরে কুসংস্কারাচ্ছন্ন রাগে তিনি মসজিদটি ভেঙে ফেলার আদেশ দেন। তবে মিনারটি অক্ষত রাখা হয়।
১৭৬৮ সালে রাশিয়ায় ধর্মীয় সহনশীলতা ঘোষণাকারী ক্যাথরিন দ্য গ্রেট (১৭৬২ থেকে ১৭৯৬ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার শাসক সম্রাজ্ঞী) একটি বিশেষ ব্যক্তিগত আদেশের মাধ্যমে কাসিমভের মসজিদটি পুনর্নির্মাণের অনুমতি দেন।
১৯৩৯ সাল থেকে মসজিদ প্রাঙ্গণে স্থানীয় ইতিহাসভিত্তিক একটি জাদুঘর চালু করা হয়েছিল, তবে মসজিদ ভবন ও মিনারটি অক্ষত অবস্থায় ছিল। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে মসজিদ ও মিনারটি কাসিমভের মুসলিমদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
৪. মারজানি মসজিদ, কাজান – ১৮শ শতাব্দী
১৭৬৭ সালে সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিন (দ্বিতীয়) ভোলগা নদী পথে কাজান ভ্রমণে যান। এ সময় শহরের মুসলমানরা তাকে মূল্যবান উপহার প্রদান করেন এবং তার কাছে শহরে একটি মসজিদ নির্মাণের অনুমতি নেন।
মসজিদটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হতে তিন বছর সময় লাগে। এটি ছিল ইভান দ্য টেরিবলের কাজান জয়ের পর নির্মিত প্রথম পাথরের মসজিদ। ছাদের ওপর মিনারসহ তাতারদের মধ্যযুগীয় স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত হয়েছিল মসজিদটি। সোভিয়েত আমলে মারজানি মসজিদই ছিল কাজানের একমাত্র কার্যকরী মসজিদ।
৫. হোয়াইট মসজিদ, আস্ত্রাখান – ১৮-১৯শ শতক
১৭৭৭ সালে একজন প্রথম শ্রেণির তাতার ব্যবসায়ী ডেভিড ইজমাইলভের অর্থায়নে কাঠ দিয়ে এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়। ১৮১০ সালে এটি পুনর্নির্মাণ করা হয়। ১৯৩০ সাল পর্যন্ত মসজিদটি চালু ছিল, এরপর তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সোভিয়েত আমলে এই ভবন একাধিকবার পুনর্নির্মাণ করে কিন্ডারগার্টেন, সেলাই কারখানা, বেকারি ও প্লাইউড কারখানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সোভিয়েত আমলে মসজিদটি দখল করার পর এর মিনার ধ্বংস করা হয়, জানালাগুলো খুলে ফেলা হয় এবং ভবনটি তিনটি তলায় ভাগ করা হয়।
পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে এই মসজিদকে একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং ১৯৯২ সালে তা মুসলিমদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ২০০৮ সালে কাজানের মুসলিম নাগরিকদের আর্থিক সহায়তায় মসজিদটি ঐতিহাসিক রূপ ফিরে পায়।
৬. পুরাতন মসজিদ, মস্কো – ১৯শ শতাব্দী
১৭১২ সালে এই মসজিদ প্রথম নির্মাণ করা হয়। ১৮২৩ সালে মস্কোর গভর্নর দিমিত্রি গোলিতসিন ঐতিহাসিক এই মসজিদ পুনর্নির্মাণের অনুমতি দেন। তবে আশেপাশের বাড়ি ও মসজিদ ভবনের মাঝে কোনো পাথর্ক্য না রাখতে তিনি মসজিদের বাহিরের অংশে ইসলামিক স্থাপত্যের ছাপ না রাখার নির্দেশ দেন।
পরবর্তীতে আলেকজান্ডারের (তৃতীয়) শাসনামলে একসঙ্গে ১,৫০০ মুসল্লির ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন করে একটি মিনার ও গম্বুজসহ মসজিদটি বর্তমান রূপে পুনর্নির্মাণ করা হয়। ১৯০৪ সালে মস্কো ক্যাথেড্রাল মসজিদ নির্মাণের আগ পর্যন্ত এটি ছিল রাশিয়ার প্রধান মসজিদ।
১৯৩৬ সালে পুরাতন মসজিদের ইমাম আবদুল্লাহ শামসুদ্দীনকে ফাঁসি দেওয়া হয় এবং ১৯৩৯ সালে মসজিদটি বন্ধ করে ভবনটি বেসামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে তুলে দেওয়া হয়। ১৯৬৭ সালে মিনারটিও ভেঙে ফেলা হয়। তবে ১৯৯২-১৯৯৩ সালে সৌদি আরবের দূতাবাসের অর্থায়নে মসজিদটি পুনরায় সংস্কার করা হয় এবং মুসল্লিদের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
৭. পুরাতন মসজিদ (তুকায়েভ মসজিদ), উফা – ১৯শ শতাব্দী
উফায় প্রথম ক্যাথেড্রাল মসজিদ নির্মিত হয় ১৮৩০ সালে। এই মসজিদটি সোভিয়েত শাসনামলেও চালু ছিল। ১৯৬০ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত এটি ছিল উফার একমাত্র কার্যকরী মসজিদ, এবং সেই সময়ে মসজিদ সংলগ্ন মাদরাসার ভিত্তিতে তাতার জাতীয় বিদ্যালয়ও চালু ছিল।
 
		
