ঢাকার সাভারের খাগান এলাকায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। রাতভর সংঘর্ষের পর ২৭ অক্টোবর সকালে সিটি ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে গিয়ে ধ্বংসস্তূপের চিহ্ন দেখা গেছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে।
এই অবস্থার মধ্যে ২৮ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।
পাশাপাশি রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মীর আকতার হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিতে ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যার মধ্যে চারটি আবাসিক হলের শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সিটি ইউনিভার্সিটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা উজ্জল সরকার সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, “ড্যাফোডিলের শিক্ষার্থীরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। তারা গানপাউডার নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। গেইটে আগুন দেয়। তারা আমাদের অ্যাকাউন্টস সম্পূর্ণ লুট করে নিয়ে গেছে।”
কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে হামলা-ভাঙচুরে তাদের ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. আরাফাতুল ইসলাম বলেন, “শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারামারি হয়েছে। পুলিশ ঘটনাস্থলে রয়েছে। ঝগড়া-বিবাদ, ভাঙচুর যা হয়েছে রাতেই হয়ে গেছে।
“আর এ ঘটনা কেন ঘটল, সেটি আসলে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বাইরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমরা ভিতরে ঢুকতে পারিনি ভিতরে কী অবস্থা জানি না।”
তুচ্ছ ঘটনা দিয়ে শুরু
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় থুতু ফেলাকে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত হয়।
ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের ভাড়া বাসা ‘ব্যাচেলর প্যারাডাইস হোস্টেল’ এর পাশে বসে ছিলো সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। এদের মধ্যে একজন থুতু ফেললে তা অসর্তকতাবশত ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থীর শরীরে লাগে,যে মোটরসাইকেল দিয়ে যাচ্ছিলো।
এ নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। পরে রাত ৯টার দিকে সিটি ইউনিভার্সিটির প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থী লাঠিসোঁটা ও ইট-পাটকেল নিয়ে ড্যাফোডিল শিক্ষার্থীদের ভাড়া করা ওই বাসায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেন।
এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা ঘটনাস্থলে জড়ো হন। একপর্যায়ে তারা সিটি ইউনিভার্সিটির দিকে অগ্রসর হন। এ সময় উভয় পক্ষের মধ্যে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
এ সময় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা সেখানে উপস্থিত হন। তারা সিটি ইউনিভার্সিটির প্রশাসনকে বিষয়টি জানিয়ে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান।
সিটি ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান বলেন, “রোববার রাতে থুতু ফেলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ড্যাফোডিল ও সিটি ইউনিভার্সিটির দুজন শিক্ষার্থীর মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। বিষয়টি রাত ১০ টার দিকে সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু রাত ১০টার পর থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত ড্যাফোডিলের অসংখ্য শিক্ষার্থী সিটি ইউনিভার্সিটিতে হামলা চালায়।”
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক সৈয়দ মিজানুর রহমান বলেন, “অসর্তকতাবশতই সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের ফেলা থুতু ড্যাফোডিলের শিক্ষার্থীর শরীরে লাগে। সেখানে ‘সরি’ বলে বিষয়টি সমাধান হয়ে যায়।
“কিন্তু রাতে এসে ড্যাফোডিলের শিক্ষার্থীদের মেসে ভাঙচুরের ঘটনাটি কাম্য নয়। উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আমাদেরই সন্তান, আমাদের শিক্ষার্থী। আমরা চেষ্টা করছি, বিষয়টি সমাধানের।”
তবে সিটি ইউনিভার্সিটির প্রক্টর অধ্যাপক আবু জায়েদ বলেন, “ঘটনার সূত্রপাত কিভাবে হয়েছে সেটি এখনো আমরা নিশ্চিত নই। ছাত্রদের মারামারি থেকে ক্যাম্পাস পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা হতে পারে? এটি পরিকল্পিত। আমাদের শিক্ষার্থী আহতের সংখ্যা আনুমানিক অর্ধশতাধিক হতে পারে।”
সকালে সিটি ইউনিভার্সিটির চিত্র
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মধ্যরাতে ড্যাফোডিলের শিক্ষার্থীরা সিটি ইউনিভার্সিটির সীমানা প্রাচীর ভেঙে ক্যাম্পাসে ঢুকেন। এ সময় ক্যাম্পাসে দাঁড় করিয়ে রাখা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়।
ক্যাম্পাসে প্রবেশের ফটকেই দেখা যায়, আগুনে পোড়ার দৃশ্য। বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কাঁচ, কাঠসহ ভাঙা বিভিন্ন জিনিসপত্র।
ভেঙে দেওয়া হয়েছে একটি প্রাইভেট কার, দুইটি মাইক্রোবাস, দুইটি মোটরসাইকেল। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে অন্তত তিনটি বাস, পাঁচটি মাইক্রোবাস ও একটি প্রাইভেট কারে। এর মধ্যে কোনোটিতে সকালেও ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়।
পুরো ভবনের জানালার থাই গ্লাস ভাঙা দেখা যায়, কোনোটি সম্পূর্ণ ভাঙা হয়েছে, কোনোটি আংশিক ভাঙা হয়েছে। ভেতরে ঢুকে প্রায় প্রতিটি ফ্লোরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায় ফাইলপত্র, ভাঙা কাচ ও আসবাবপত্র।
প্রায় প্রতিটি কক্ষের চেয়ার, টেবিল, কম্পিউটার, বাথরুমের কমোড, বেসিন, দরজা, এসি, ফটোকপি মেশিন, প্রিন্টার ভাঙা পড়ে রয়েছে। অফিসকক্ষ, অভ্যর্থনাকক্ষ ও কর্মকর্তাদের ডেস্কগুলো অনেকাংশে ভাঙচুর ও তছনছ করে দেওয়া হয়েছে।
সিটি ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী বলেন, “ঘুমন্ত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা হয়েছে। তারা অস্ত্র নিয়ে আসে। মেয়েদের হলের কলাপসিবল গেইটে ভাঙচুরের চেষ্টা করে, ইট ছুঁড়ে মারে। সেগুলো মেয়েদের গায়ে লাগছে। আমাদের পুরো ক্যাম্পাস ভাঙচুর করেছে।”
হামলা ও ধ্বংসের ভয়াবহতার সত্যতা নিজের চোখেও দেখেছেন ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির সায়েন্স অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজিস বিভাগের ডিন অধ্যাপক বিমল চন্দ্র দাস। ২৭ অক্টোবর দুপুরে তিনি সিটি ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে আটকে রাখা শিক্ষার্থীদের ছাড়িয়ে নিতে এসেছিলেন।
তখন তিনি সিটি ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস পরিদর্শন করেন এবং ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের চিত্র দেখে দুঃখ প্রকাশ করেন।
এ সময় বিমল চন্দ্র দাস বলেন, “রাতে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি ও সিটি ইউনিভার্সিটির মধ্যে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, সেটা দেখার জন্য এসেছি। এখানে যে ভাঙচুর ও ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে, সেজন্য আমি সত্যি সত্যি লজ্জিত এবং এর জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি।
“শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন ধ্বংসযজ্ঞ হতে পারে, এটা আমাদের ধারণার বাইরে। এটা যারাই ঘটিয়েছে, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত।”
প্রশাসনের সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ
এদিকে সিটি ইউনিভার্সিটির টেক্সটাইল ইন্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আরিফুজ্জামান অভিযোগ করে বলেন, “রাত ১২টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত প্রশাসনের অনেক সহযোগিতা চেয়েছি আমরা। ওরা এসে পুরো ক্যাম্পাসে আগুন দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। শত শত ছাত্রকে মারছে, আহত করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা পাইনি।
“তারা খাগান পর্যন্ত এসেছে। ড্যাফোডিলের ছেলেরা এখান পর্যন্ত এসে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। কেউ রক্ষা করতে আসেনি। টানা হামলা হয়েছে, কিন্তু কেউ আসেনি। হাজার হাজার ছাত্র এখানে, আমরা খুব অসহায় হয়ে পড়েছি। দুইটা ছাত্রী হল আছে, তারাও আতঙ্কে ছিল। আমরা সবাই নিরাপত্তাহীনতায় আছি।”
সিটি ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান বলেন, “পুলিশ প্রশাসনকে বিষয়টি জানানো হলেও তারা কোনো সহযোগিতা করেনি। হামলায় আমাদের ২৫ থেকে ২৬ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আরো প্রায় শতাধিক আহত হয়েছেন। তারা শিক্ষার্থীসুলভ আচরণ করেনি।”
সাভার মডেল থানার অধীন বিরুলিয়া ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আব্দুল ওহাব তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথমে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা করলে পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার দিকে এগোচ্ছিল। এরই মধ্যে সিটি ইউনিভার্সিটি সংলগ্ন এলাকায় শিক্ষার্থীরা ড্যাফোডিলের এক শিক্ষার্থীকে মারধর করলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।”
 
		

