চলছিলো না কোন নির্মাণকাজ, ব্যস্ত ঢাকার জনাকীর্ণ সড়ক, পথচলার সময় শুকনো আকাশ থেকে যেনো বাজ পড়লো। প্রাণ গেলো দুই সন্তানের বাবা কামালের। কিশোর বয়সে বাবা–মাকে হারিয়েছিলেন আবুল কালাম। এরপর ভাই-বোনদের সংসারে বেড়ে ওঠেন। কঠোর পরিশ্রম করে সংসারের সচ্ছলতা ফেরাতে চেষ্টা করছিলেন। পরিবারের প্রিয় মানুষটি মাত্র ৩৫ বছর বয়সে মারা গেছেন। ২৬ অক্টোবর রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের পিলারের একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়লে এর আঘাতে নিহত হন তিনি।
আবুল কালামের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মোক্তারের চর ইউনিয়নের ঈশ্বরকাঠি গ্রামে। তাঁর এমন অকালমৃত্যু মানতে পারছেন না স্বজন ও গ্রামের মানুষেরা।
ঈশ্বরকাঠি গ্রামের বাসিন্দারা জানান, ঈশ্বরকাঠি গ্রামের জলিল চোকদার ও হনুফা বেগম দম্পতির ছেলে আবুল কালাম। চার ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে আবুল কালাম ভাইদের মধ্যে সবার ছোট। ২০ বছর আগে তাঁর বাবা ও মা মারা যান। এরপর তিনি বড় হন বড় ভাই ও বোনদের কাছে।
সংসারের স্বাচ্ছন্দ্য ফেরাতে ২০১২ সালে মালয়েশিয়ায় যান আবুল কালাম। সেখান থেকে ফিরে ২০১৮ সালে পাশের গ্রামের আইরিন আক্তারকে বিয়ে করেন। দাম্পত্য জীবনে তাঁদের ছয় বছরের এক ছেলে ও চার বছর বয়সী এক মেয়েসন্তান রয়েছে। স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান নিয়ে আবুল কালাম নারায়ণগঞ্জের পাঠানটুলী এলাকায় বসবাস করতেন। ঢাকার মতিঝিলের একটি ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে কাজ করতেন। ওই কাজের জন্যই প্রতিদিন তিনি নারায়ণগঞ্জ–ঢাকা যাতায়াত করতেন।
প্রতিদিনের মতো ২৭ অক্টোবর সকালে নারায়ণগঞ্জ থেকে মতিঝিলে আসেন আবুল কালাম। এরপর কাজের জন্য সেখান থেকে বের হন। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের পিলারের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে যায়। সেটির নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারান আবুল কালাম। এরপর গণমাধ্যমের সংবাদে পরিবারের সদস্যরা তাঁর মৃত্যুর খবর জানতে পারেন।
আবুল কালামের মৃত্যুর খবরে শোকার্ত ঈশ্বরকাটি গ্রামের বাসিন্দারা। কান্নায় ভেঙে পড়েন গ্রামে থাকা তাঁর স্বজনেরা। অনেকে ছুটে যান ঢাকায়।
তদন্ত কমিটি গঠন
রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার কারণ অনুসন্ধানে একটি কমিটি গঠন করেছে সরকার। বিয়ারিং পড়ে নিহত যুবকের পরিবারকে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্তও হয়েছে। সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান।
বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনা নিয়ে উপদেষ্টা বলেন, এ ঘটনাটা কি নাশকতা, নাকি নির্মাণত্রুটির কারণে হয়েছে, সেটা খুঁজে বের করতে সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
পাঁচ সদস্যের এ কমিটিতে থাকছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক ড. এ বি এম তৌফিক হাসান, এমআইএসটির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. জাহিদুল ইসলাম, ডিএমটিসিএল-এর লাইন-৫-এর প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব। উপসচিব আসফিয়া সুলতানা কমিটিতে সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করবেন।
এই কমিটিকে দুই সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরেও ফার্মগেটে মেট্রোরেল লাইনের পিলারের একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল। এবারের কমিটি আগের ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদনও পর্যালোচনা করবে জানিয়ে উপদেষ্টা ফাওজুল কবির বলেন, কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জীবনের দাম পাঁচ লাখ
‘এইটা মৃত্যু না, হত্যা। এইটা মেট্রো কর্তৃপক্ষের অবহেলা। টাকা বা চাকরি দিয়ে এর ক্ষতিপূরণ হবে না। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এই অবহেলায় জড়িতদের শাস্তি দিতে হবে।’ স্বামীকে হারিয়ে পাঁচ বছরের ছেলে আব্দুল্লাহকে কোলে নিয়ে আহাজারি করে কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের ট্র্যাক থেকে খুলে পড়া বিয়ারিং প্যাডের আঘাতে নিহত আবুল কালামের (৩৫) স্ত্রী আইরিন আক্তার প্রিয়া।
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেটার বয়স পাঁচ বছর, মেয়ের তিন বছর। বাচ্চা দুটি তাদের বাবাকে হারাল। সেটার ক্ষতিপূরণ কীভাবে হবে?’
বিয়ারিং প্যাড কী, কোন কাজে লাগে
মেট্রোরেলের ‘বিয়ারিং প্যাড’ হচ্ছে রাবার ও ইস্পাতের মিশ্রণে তৈরি আয়তাকার একধরনের প্যাড, যা অনেকটা বিছানার ম্যাট্রেসের মতো করে ব্যবহৃত হয়। মেট্রোরেলের উড়ালপথটিকে বলা হয় ভায়াডাক্ট। এর ওপরই রেললাইনসহ যাবতীয় স্থাপনা বসানো হয়। আবার ভায়াডাক্ট বসানো হয় স্তম্ভ বা পিলারের ওপর। এই স্তম্ভকে প্রকৌশলের ভাষায় বলা হয় পিয়ার।
মেট্রোরেলের উড়ালপথটি কংক্রিটের তৈরি, যা ৩০ থেকে ৪০ মিটার লম্বা একেকটি স্প্যান জোড়া দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। যেহেতু ভায়াডাক্ট ও পিয়ার দুটিই কংক্রিটের তৈরি, তাই দুটি কংক্রিটের বস্তুর একটির ওপর আরেকটি স্থাপন করলে ঘর্ষণজনিত সমস্যা হতে পারে। হতে পারে ক্ষয়, ঘটতে পারে স্থানচ্যুতিও। এ জন্যই ভায়াডাক্ট ও পিলারের মাঝখানে রাবার ও স্টিলের তৈরি বিয়ারিং প্যাড দেওয়া হয়, যা স্থাপনাটির সুরক্ষায় কাজ করে।
ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। কোম্পানির সূত্র বলছে, দুই পিলারের মাঝখানের প্রতিটি স্প্যানের জন্য চারটি করে বিয়ারিং প্যাড রয়েছে; অর্থাৎ একেকটি পিলারের আছে চারটি করে রাবার প্যাড। এগুলোর স্তরে স্তরে রাবার ও বিশেষ স্টিল দিয়ে তৈরি।
কেনো খুলে পড়ছে বিয়ারিং প্যাড
পিলার ও ভায়াডাক্টের সংযোগস্থলে বিয়ারিং প্যাডগুলো বসানোর জন্য বেজ বা ভিত্তি রয়েছে। এটি নাট-বল্টু কিংবা অন্য কিছু দিয়ে আটকানো থাকে না; বরং পিলার ও ভায়াডাক্টের মতো ভারী বস্তুর চাপে এটি টিকে থাকে। একেকটি স্প্যানের ওজন কয়েক শ টন হবে। কেন এই দুই ভারী বস্তুর চাপের পরও এভাবে ভিত্তি থেকে ছিটকে বিয়ারিং প্যাড নিচে পড়ে গেল, তা সবার কাছেই বড় প্রশ্ন। কারণ, এ ধরনের ঘটনা মেট্রোরেলের ইতিহাসে অনেকটা বিরল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এর পেছনে নকশাগত ত্রুটি থাকতে পারে বলে মনে করেন ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা। মেট্রোরেলের লাইনসহ যাবতীয় নকশা প্রণয়নের দায়িত্বে ছিল জাপানের কয়েকটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের জোট এনকেডিএম অ্যাসোসিয়েশন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, বিয়ারিং প্যাডটি বসানো হয়েছে মেট্রোর নিরাপদ চলাচল ও স্থাপনার স্থায়িত্ব ধরে রাখতে। কিন্তু এই ব্যবস্থা নিচে পড়ে মানুষ মারা গেলে তো বলতে হবে এর নকশাগত ত্রুটি থাকতে পারে। মেট্রোরেলের জন্য সবচেয়ে দামি জাপানি পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাহলে তাঁদের নকশায় কী কোনো ত্রুটি ছিল।
এই অধ্যাপক বলেন, মেট্রোরেলের চলাচলের কারণে কম্পনজনিত ভার তৈরি হয়। এটা তো যেকোনো প্রকৌশলীর জানার কথা। এর জন্য যেখানে নাট-বল্টু থাকে, সেগুলো নিয়মিত পরীক্ষা করতে হয়। কিন্তু মেট্রোরেলের পিলারের ওপর তো বিয়ারিং প্যাড দেওয়া হয়েছে। তা যাতে নিচে না পড়ে যায়, সেই ব্যবস্থা থাকা দরকার ছিল।
ডিএমটিসিএলের কোনো কোনো কর্মকর্তা মনে করেন, মেট্রোরেলের যে স্থানটিতে দুবার বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছে, সেই জায়গাটিতে বড় বাঁক রয়েছে। এ ছাড়া স্থানটি অন্য স্থানের চেয়ে কিছুটা উঁচুও। কারণ, বিজয় সরণি স্টেশনটি দোতলা, কিন্তু ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজার স্টেশন তিনতলা; অর্থাৎ বিজয় সরণি থেকে আস্তে আস্তে রেলপথটি ফার্মগেটে আসতে আসতে উঁচুতে উঠে গেছে।
এটাকে অবশ্য দুর্ঘটনার কারণ বলতে নারাজ অধ্যাপক সামছুল হক। তিনি বলেন, বাঁক ও উঁচু হওয়া প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জের বিষয়। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য নকশা করা হয় এবং বাড়তি খরচ করতে হয়। মেট্রোরেলেও তা হয়েছে। এরপরও কেন নিরাপত্তাঝুঁকি থাকবে? এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি আরও বলেন, জাপানের সব স্থাপনা ‘সিক্স সিগমা কমপ্লায়েন্স’ মেনে চলা হয়; অর্থাৎ প্রকৌশগত স্থাপনায় ১০ লাখের মধ্যে একটা ভুল হতে পারে। সেই জাপানি প্রযুক্তি, পরামর্শক এবং ঠিকাদারের মাধ্যমে করা মেট্রোরেলে একাধিকবার কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটে? এর জন্য একটি স্বাধীন নিরাপত্তা অডিট করা দরকার।
 
		

